আপনাদের মধ্যে অনেকেই রোটা ভাইরাসের নাম শুনেছেন। আবার অনেকে এ ভাইরাস সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে সব ধরনের রোগ ও এর প্রতিরোধের উপায় জেনে রাখতে হবে। তাহলে অতি সহজেই এসব থেকে বেঁচে থাকা যায়।এবার চলুন জেনে নেই এই ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
রোটা ভাইরাস কি
রোটা ভাইরাস হলো এমন এক ধরনের ভাইরাস যা ছোঁয়াচে হয় ও দ্রুত সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নবজাতক শিশুর ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতার প্রধান কারণ এই রোটা ভাইরাস।
এটি মূলত খাদ্যনালীতে সংক্রমন ঘটায়। এর কারণেই ডায়রিয়া, বমি ইত্যাদি সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের এ ভাইরাস বেশি আক্রমণ করে থাকে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ৬০-৮০ ভাগই রোটা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। এটি মূলত অন্ত্রের সংক্রমণ। এটি সরাসরি অন্ত্রকে আক্রমণ করে বিধায় শিশুর মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
আমাদের দেশে শীতকালে এ ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। এর ফলে ডায়রিয়া ও বমি বেড়ে যায় ও শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি বড়দের মধ্যে তেমন কোন ক্ষতি না করতে পারলেও বাচ্চাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এর ফলে বাচ্চাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই এই ভাইরাস সম্পর্কে জানতে হবে ও এর প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোটা ভাইরাস কেনো হয়
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে রোটা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেসব কারণে রোটা ভাইরাস আক্রমণ করে তা অবশ্যই সবার জেনে রাখা ভালো। নিচে তা দেওয়া হলো…
- অপরিচ্ছন্ন থাকলে এ ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির মলমূত্র থেকে ও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
- দূষিত পানি পান করলে ও এ ভাইরাস অন্ত্রে বাসা বাঁধে।
- উপরোক্ত এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলে রোটা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
যেভাবে শনাক্ত করা যায় এই ভাইরাস
শিশুর মলের নমুনা সংগ্রহ করে এলাইজা বা পিসিআর পরীক্ষা করার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় এই ভাইরাস।তবে প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাস শনাক্ত করা যায় না। কারণ এর লক্ষণ সাধারণ ডায়রিয়ার লক্ষণের মতোই হয়ে থাকে। এজন্য অভিভাবকরা ও এটি বুঝতে পারেন না।
রোটা ভাইরাসের লক্ষণ
রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেক লক্ষণই প্রকাশ পায়। যার ফলে তাৎক্ষণিক ভাবে এটি শনাক্ত করা যায়। তবে ভাইরাস দেহে প্রবেশের দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হলো:
- জ্বর আসে।
- পেট খারাপ ও বমি হয়।
- পেটে ব্যথা হয়।
- ডায়রিয়া হয়।
- ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় , রোগী কিছু খেতে পারে না।
- ডিহাইড্রেশন হয়।
- গলা শুকিয়ে যায়।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।
- মাথা ব্যথা করে ও মাথা ঘুরায়।
- শরীরের মধ্যে অস্বস্তিবোধ হতে পারে।
- শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
উপরোক্ত লক্ষনগুলো দেখা দিলে দেরি না করে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে।
রোটা ভাইরাস হলে করণীয়
রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়লে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে। দেরী করলে চলবে না। কারণ এটি মারাত্মক একটি ভাইরাস। এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। কোনো অ্যান্টি বায়োটিক এ ভাইরাস দমন করতে পারে না। আবার এর জন্য কোনো অ্যান্টি ভাইরাল ঔষধও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়লে যা করতে হবে তা সবারই জেনে রাখা জরুরি।
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডাক্তারের দেয়া ঔষধ সেবন করতে হবে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। - নিজের খাবারের প্লেট , গ্লাস ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র আলাদা রাখতে হবে।
- হাঁচি কাশি দেয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করতে হবে।
- জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।
- শরীর থেকে বেড়িয়ে যাওয়া পানি ও লবণের ঘাটতি পূরণে পানি জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণ খেতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, লেবুর শরবত, ডাবের পানি, ঘোল,চিনির শরবত ইত্যাদি।
- রাইস স্যালাইন খেতে হবে।
- ওরাল স্যালাইন প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।নাহলে পানিশূন্যতা দূর করা সম্ভব হবে না।
- তেলজাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে।
- বাইরের খাবার খাওয়া যাবে না।
- খাবার ভালোমতো রান্না করে খেতে হবে।এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন।
রোটা ভাইরাসের টিকা
সব ধরনের রোগের ক্ষেত্রেই প্রতিরোধক হিসেবে টিকা গ্রহণ করতে হয়। এতে করে ওই রোগ থেকে বাঁচা যায় বা ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেও তেমন কোন ক্ষতি হয় না। রোটা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও টিকা গ্রহণ করতে হয়। এই ভাইরাসের দুই ধরনের টিকা রয়েছে। একটি হলো রোটা রিক্স (Rotarix) ও আরেকটি রোটা টেক(Rotatek)। এই দুই ভ্যাকসিন বা টিকা গ্রহণ করলে শিশুরা এই ভাইরাসের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়।
রোটা ভাইরাসের টিকার মূল্য
- রোটা রিক্স দুই ডোজ নিতে হয় ও এর মূল্য পরবে ১৮০০ টাকা প্রতি ডোজ।
- রোটা টেক তিন ডোজ নিতে হয় ও এর মূল্য প্রতি ডোজ ১৬০০ টাকা।
আরও পড়ুনঃ চিনেনিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের লক্ষণ গুলো কি কি
কখন দিতে হবে এই টিকা
রোটা টেক বাচ্চাদের ২,৪ ও ৬ মাস বয়সে দিতে হয়। রোটা রিক্স বাচ্চাদের ২ ও ৪ মাস বয়সে দিতে হয়। শিশুদের বয়স ছয়মাস হওয়া পর্যন্ত এ টিকা দিয়ে দিতে হবে। এই টিকা মুখে খাওয়ানো হয়। সূচবিহীন সিরিঞ্জের সাহায্যে এ টিকা ফোঁটা ফোঁটা করে বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়। সঠিক সময়ে এই টিকা গ্রহণ করতে পারলে এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
কোথায় পাবেন এই টিকা
বাংলাদেশে এ টিকা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে পাওয়া যাবে।
রোটা ভাইরাসের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
এ টিকা গ্রহণে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। তবে কিছু কিছু শিশুর জ্বর ও দূর্বলতা হতে পারে যা সাধারণ অ্যান্টি বায়োটিক ঔষধ সেবন করলেই চলে যেতে পারে।
আরোও পড়ুনঃ জেনেনিন শিশুদের নিউমোনিয়ার টিকা কখন দিতে হয়
আক্রান্ত শিশু যেসব খাবার খেতে পারবে
রোটা ভাইরাস সরাসরি শিশুর অন্ত্রে আক্রমণ করে। ফলে শিশুর খাওয়া দাওয়ায় পরিবর্তন আনতে হয়।এ ভাইরাসে আক্রান্ত শিশু যেসব খাবার খেতে পারবে তা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো:
- তরল জাতীয় যেকোনো খাবার খেতে হবে।
শরীরে পানির চাহিদা পূরণে ওরাল স্যালাইন খাওয়াতে হবে বেশি পরিমাণে। - ছোট শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে। এটি এই ভাইরাস প্রতিরোধে অধিক কার্যকর।
- ফলমুল ও শাকসবজি খাওয়ানো যাবে।
- এসব খাবারের পাশাপাশি রাইস স্যালাইন ও ঘরে তৈরি খাবার স্যালাইন ও খাওয়াতে হবে।
রোটা ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়
এ ভাইরাস প্রতিরোধে সকলকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। নাহলে এই মারাত্মক ব্যধি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা ও রয়েছে। এজন্য যা করা দরকার তা আলোচনা করা হলো।
- শিশুদের মেঝেতে খেলতে দেয়া যাবে না । এর ফলে জীবাণু অতি সহজেই তাদের হাতের মাধ্যমে তাদের মুখে প্রবেশ করতে পারে।
- তাদের মলমূত্র ত্যাগের পর ভালোমতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- তাদের হাত যেন ময়লা বা অপরিচ্ছন্ন না থাকে এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
- পরিষ্কার পাত্রে তাদের খাবার খাওয়াতে হবে।
- জীবাণুমুক্ত নিরাপদ পানি পান করাতে হবে।
- বাইরের খাবার খাওয়ানো যাবে না।
- ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ শিশুদের জন্য টি টি টিকার উপকারিতা
বিঃ দ্রঃ
সর্বোপরি স্বাস্থ্যকর খাবার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। এভাবেই এই রোটা ভাইরাস দমন করা সম্ভব হবে।