আসসালামুয়ালাইকুম পাঠকবৃন্দ। আজকের প্রতিবেদন টি মূলত কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে। এই রোগটি আমাদের সকলের পরিচিত। বিভিন্ন ধরনের রোগের মধ্যে কুষ্ঠরোগ অন্যতম।এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ।পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি মিশর, চীন, গ্রিক, রোম, ভারত ইত্যাদি প্রায় সব দেশের ইতিকথায় এই রোগের বিবরণ পাওয়া যায়। চলুন এবার জেনে নিই এ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত।
কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ
কুষ্ঠ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করা মাত্রই কিন্তু এর লক্ষণ দেখা দেয় না। এজন্য তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যেতে পারে। অনেক সময় এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৫ থেকে ২০ বছরও লাগতে পারে। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রাথমিকভাবে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তা হলো:
-
-
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়, ত্বকের রং পরিবর্তন হয় ও ছোপ ছোপ
- দাগ দেখা দেয়।
- শরীরের মাংসপেশী দুর্বল হয়ে পড়ে।
- ত্বক জ্বালা করে ও অনেক গরম অনুভব হয় ।
- হাত ও পায়ে ঘা সৃষ্টি হয়।
- শরীর অসাড় হয়ে যায়।
- চুল ও চোখের পাপড়ি উঠে যায়।
-
- দীর্ঘদিন ধরে জ্বর ও কাশি হয়।
- চোখের পাতার ভেতরের অংশে ঘা সৃষ্টি হয়।
- নাক দিয়ে রক্ত পড়ে।
- শরীরের ত্বকে ছোট ছোট পিন্ড দেখা দেয়।
- ত্বকে লালচে দাগ ও দেখা দিতে পারে।
- মুখ ও কানের লতিতে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
- ত্বকের বিভিন্ন অংশের অনুভূতি হ্রাস পেতে পারে।
- হাত পা নাড়াতে সমস্যা হয় ও অবশ হয়ে যায়।
- শরীর পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
উপরোক্ত লক্ষনগুলো দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলেই এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
কুষ্ঠরোগ (Leprosy) কি
কুষ্ঠরোগের ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। আল কোরআন ও বাইবেলে ও এ রোগ সম্পর্কে বলা হয়েছে। কুষ্ঠরোগকে “হ্যানসেনের রোগ” (এইচডি) ও বলা হয়ে থাকে।কারণ ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসেন তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে কুষ্ঠ একটি জীবাণুবাহিত রোগ যা নিরাময়যোগ্য।
এটি যে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয় তার নাম হলো “মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রি” বা “মাইকোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রোমাটোসিস”। এ ব্যাক্টেরিয়া মানবদেহের স্নায়ু ,শ্বাসতন্ত্র ,চোখ ও ত্বকের ক্ষতি করে থাকে। World Health Organization বা WHO এর মতে , কুষ্ঠরোগ খুব সম্ভবত শ্বাসতন্ত্র ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। আবার অনেকে মনে করেন এটি এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণেও হতে পারে।
কুষ্ঠরোগের কারণে বিশেষ করে মস্তিষ্ক , মেরুদন্ডের বাইরের দিকের স্নায়ু , অন্ডকোষ , ত্বক ও চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেকোনো বয়েসের মানুষই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এর কোনো বয়সসীমা নেই। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তারা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। প্রায় ৯৫% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জোরে এ রোগ থেকে বেঁচে রয়েছেন।
এই রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার শেষ নেই।অনেকে এটাকে বংশগত রোগ মনে করে।তবে তা ঠিক না। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। সব ধরনের কুষ্ঠ রোগ ছড়ায় না। এ রোগের মধ্যেও দুটি ধরন রয়েছে । একটি হলো অধিক রোগ জীবাণু সম্পন্ন কুষ্ঠ রোগ এবং আরেকটি হলো কম রোগ জীবাণু সম্পন্ন কুষ্ঠ রোগ।
অধিক রোগ জীবাণু সম্পন্ন কুষ্ঠ রোগই এই রোগ সংক্রমণের প্রধান উৎস। এর জীবাণু রোগীর হাঁচি কাশির মাধ্যমে অন্য সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে তাকে আক্রান্ত করে দেয়। কম রোগ জীবাণু সম্পন্ন কুষ্ঠ রোগ খুব একটা ছড়ায় না। তবে এ ধরনের কুষ্ঠ রোগীর সাথে ও যথাসম্ভব কম মেলামেশা করা উচিত।
আরোও পড়ুনঃ যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসা
কুষ্ঠ রোগের প্রকারভেদ
- টিউবারকুলার লেপ্রসি
- ইন্টারমিডিয়েট লেপ্রসি
- লেপ্রোমাটাস লেপ্রসি
একেক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে একেক ধরনের কুষ্ঠ রোগের বিস্তার ঘটে। একজন কুষ্ঠরোগী তার শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি মানসিক ভাবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা এ রোগের কারণে তাকে সবাই অবহেলা করে, ঘৃণা করে। তাকে আলাদা করে দেয়। অনেক পরিবার তো বাসা থেকেই বের করে দেয়। কিন্তু এটি মোটেও ঠিক নয়। কুষ্ঠরোগ কোনো অপরাধ নয়।এটি একটি জীবাণুবাহিত রোগ। এ রোগের প্রাথমিক অবস্থায় এটি শনাক্ত করতে পারলে এটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব।
এজন্য এ সম্পর্কে সকলকে জানতে হবে ও সঠিক জ্ঞান রাখতে হবে।তাই এর লক্ষণ ও উপসর্গ সম্পর্কে জানা থাকলে এটি সহজেই নিরাময় করা সম্ভব।
আরোও পড়ুনঃ শিশুদের জন্য টি টি টিকার উপকারিতা
কুষ্ঠ রোগের ঔষধ
সব ধরনের শারীরিক সমস্যার সমাধান করতে সঠিক চিকিৎসার দরকার হয়। তেমনি কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এজন্য এর চিকিৎসা ও ওষুধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় খুবই উপকারী ও লাভদায়ক হলো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম।
এসব ঔষধের মধ্যে কয়েকটি হলো
ড্যাপসন (Dapsone), ক্লোফাজামিন (Clofazamine) , রিফাম্পিসিন (Rifampicin),মাইনোসাইক্লিন (Minocycline),ফ্লুরোকুইনোলোন (fluroquinolones) ইত্যাদি।
এসব ঔষধের মধ্যে ড্যাপসন (Dapsone) ৪০-এর দশকে আবিষ্কার করা হয় ও তা তখন প্রায় দুই দশক ধরে কুষ্ঠ রোগ চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে । অতঃপর ৬০-এর দশকে কুষ্ঠ রোগের ব্যাকটেরিয়া এই ঔষধের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে ওঠে।
এজন্য নতুন কোনো ঔষধের দরকার পড়ে। আর তখনই আবিষ্কৃত হয় রিফামপিসিন ও ক্লোফাজিমিন নামক দুটি অ্যান্টি-বায়োটিক। আর ড্যাপসনের সাথে এ দুটি ঔষধ সমন্বয় করে দেখা গেলো তা বেশ কার্যকর। এরপর থেকেই শুরু হয় মাল্টি ড্রাগ থেরাপি (MDT)। এই থেরাপির মাধ্যমে তখন কুষ্ঠ রোগীদের মধ্যে ভালো উন্নতি দেখা যায়। এই মাল্টি ড্রাগ থেরাপি আবিস্কারের ফলে কুষ্ঠ রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
কুষ্ঠ রোগের কারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য অ্যান্টি- ইনফ্লামেটারি উপাদান সমৃদ্ধ ঔষধ সেবন করতে হয়। অ্যান্টি – ইনফ্লামেটারি উপাদান সমৃদ্ধ ঔষধের মধ্যে রয়েছে : অ্যাস্পিরিন(Aspirin), প্রেডনিসোন(Prednisone) এবং থালিডোমাইড(Thalidomide) ইত্যাদি। এছাড়াও এই রোগ গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে চিকিৎসক তার যথার্থ চিকিৎসা করতে পারবেন।
কুষ্ঠ রোগের প্রতিকার
কুষ্ঠ রোগের প্রতিকার হিসেবে সঠিক উপায়ে ঔষধ সেবন করা ও নিয়মমাফিক জীবন যাপন করার বিকল্প নেই।
আমরা জানি , প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। তাই সকলকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই এর প্রতিরোধ করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে এ রোগে আক্রান্ত হতে না হয়।
আরোও পড়ুনঃ চিনেনিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের লক্ষণ গুলো কি কি
কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধে যা করতে হবে
- সর্বপ্রথম পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কারণ এ রোগ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়।
- কুষ্ঠ রোগী থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
বিসিজি (Bacillus Calmette-Guerin) টিকা গ্রহণ করতে হবে। এটি কুষ্ঠ রোগ প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকর। - প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। কারণ পুষ্টিকর খাবার না খেলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যা কুষ্ঠ রোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী চলার মাধ্যমে কুষ্ঠ রোগসহ অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
কুষ্ঠ রোগের প্রতিরোধে প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ রোববার পালিত হয় বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। এই দিবসটির প্রচলন করেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এন্টি-লেপ্রসি অ্যাসোসিয়েশনস (আইএলইপি)-এর প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফলেরিউ। ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ রোববার কুষ্ঠ রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে এই দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কুষ্ঠ রোগ নির্মূলে জোরালো কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা প্রতি দশ হাজারে একজনে নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় ১৯৯৮ সালেই বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করে।
আরোও পড়ুনঃ সব পিতা-মাতার জানা দরকার রোটা ভাইরাস কি
সতর্কতাঃ
কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে যত সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন এবং বিসিজি টিকা গ্রহণ করুন। তবে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত রোগির সাথে করমর্দন, চলাফেরা কিংবা শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হলে এ রোগ ছড়ায় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কুষ্ঠরোগ সামাজিকভাবে নিগৃহীত একটি রোগ হিসেবে প্রচলিত। তাই এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গ বা লক্ষণ বুঝতে পেরেও অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে তা লুকিয়ে রাখে। ফলে তারা আরো খারাপ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। আবার আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটি প্রবণতা আছে যে, চিকিৎসা গ্রহণের পর তারা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।
কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী অর্থাৎ এক থেকে দুই বছরেরও বেশি অধিক হয়ে থাকে। তাই তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত কোন রোগী যদি নিয়মিত সঠিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করে, তবে এ রোগ একদম নিরাময়যোগ্য। তাই, অযথা আতঙ্ক না ছড়িয়ে, কুষ্ঠ রোগ কে অবহেলা না করে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগের প্রতিকার সম্ভব।
আসুন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন না থেকে সচেতন থাকি, সুস্থ থাকি নিজ ও দেশের প্রয়োজনে।
One reply on “কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার”
[…] শিশুর বাম হাতে দেওয়া হয়। আরও পড়ুনঃ কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার আরও পড়ুনঃ রোটা ভাইরাস […]