বায়ুয়াহিত রোগগুলোর মধ্যে হাম অন্যতম। হাম রোগের জন্য প্রতি বছর লক্ষাধিক শিশু মৃত্যুবরণ করে। তাই, সুস্থ জীবন গড়তে জানতে হবে হাম রোগের লক্ষণ ও করনীয়। সঠিক দিকনির্দেশনাই পারে আপনাকে কিংবা আপনার শিশুকে হাম রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে।
হাম রোগের লক্ষণ
একজন ব্যক্তির দেহে যদি হাম ভাইরাস বাসা বাঁধে, তাহলে ৭-১৪ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ পাবে। এই সময়কালটিকে বলা হয় জীবাণুর উন্মেষপর্ব(ইনকিউবেশন পিরিয়ড)। যে সব গুরুতর বিষয় প্রকাশ পেলেই ধরে নিতে হবে যে সে হাম রোগে আক্রান্তঃ
জ্বর অন্যতম লক্ষণ। কখনো কখনো ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্তও জ্বর উঠতে পারে। জ্বরের সাথে আরও তিনটি গুরুতরও উপসর্গ থাকে যা “Three C” নামে পরিচিত।
কাশি করিজা অর্থাৎ নাকে-মুখে সর্দি
কনজাংটিভাইটিস অর্থাৎ চোখ লাল হওয়া ও পানি পড়া।
কপ্লিক স্পট
প্রাথমিক সংক্রমের ইঙ্গিত হলো কপ্লিক স্পট। মুখের ভিতর সাদা সাদা ক্ষুদ্র স্পটগুলোই কপ্লিক স্পট নামে পরিচিত। সাধারণত জ্বর হবার ২-৩ দিনের মধ্যে এটি পরিলক্ষিত হয়।
হামের গুটি
উপসর্গ এর তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সমস্ত মুখমণ্ডলে গুটি বের হওয়া শুরু হয়। যদিও ৭-১০ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হতে থাকে। সিমপমেটিক থেরাপির ব্যবস্থা করা হয়। যারা হামের গুটির দ্বারা আক্রান্ত হন, তাদেরকে বাড়ি থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়। স্কুল, কলেজ কিংবা কর্মস্থল এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রথমে মুখের ওপর থেকে শুরু করে চুল দ্বারা আবৃত স্থানে লাল স্পট পরিলক্ষিত হয়। পরে ঘাড় থেকে শুরু করে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে স্পটগুলোর ওপর ছোট ছোট ফুসকুড়ি তৈরি হয়। কিছুদিন পড়ে গুটিগুলো কমে এবং জ্বরও কম হয়।
এছাড়াও, আলোক সংবেদনশীলতা, পেশীতে ব্যাথা এই ধরণের লক্ষণগুলোর বহিঃপ্রকাশ ও ঘটে। সময় রেখা অনুযায়ী হাম রোগের রোগের লক্ষণ উপসর্গ শুরু হওয়ার ২ থেকে ৩ দিন পর: কপলিক দাগ। উপসর্গ শুরু হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পর মুখের ভিতরে ক্ষুদ্র সাদা দাগ (কপলিক দাগ) দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ শুরু হওয়ার তিন থেকে পাঁচ দিন পর: হামের ফুসকুড়ি। উপসর্গ শুরু হওয়ার তিন থেকে পাঁচ দিন পর ফুসকুড়ি বের হয়। এটি সাধারণত চ্যাপ্টা লাল দাগ হিসাবে শুরু হয় যা মুখের চুলের রেখায় প্রদর্শিত হয় এবং নীচের দিকে ঘাড়, ট্রাঙ্ক, বাহু, পা এবং পায়ে ছড়িয়ে পড়ে।
চ্যাপ্টা লাল দাগের উপরেও ছোট ছোট বাম্প দেখা দিতে পারে। মাথা থেকে শরীরের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দাগগুলি একসাথে যুক্ত হতে পারে। ফুসকুড়ি দেখা দিলে, একজন ব্যক্তির জ্বর 104° ফারেনহাইটের বেশি হতে পারে।
হাম হলে করণীয়
আপনি জেনে নিশ্চিত হবেন যে, মাত্র তিন দিনের চিকিৎসায় জ্বর সেরে যায় এবং সাত দিনের মধ্যে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়েও যায়। হামে আক্রান্ত রোগিকে নিয়মিত সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে জীবাণুনাশক দ্বারা স্নান করাতে হয়।
নির্দিষ্ট সময় পর পর ভেজা তোয়ালে অথবা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। কোনো পদক্ষেপেই অবহেলা করা যাবে না।
সব চেয়ে অবাক করা বিষয় হলো যে, সাম্প্রতিক সময়ে কলেজ- ভার্সিটি তে পড়ুয়া শিক্ষার্থী কিংবা প্রাপ্ত বয়স্কদের হাম রোগ বেশি ধরা পড়ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এর জন্য দায়ী। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই হাম থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে। তবে, ২০-৩০% শিশুদের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা যায়।
হাম কি ছোঁয়াচে?
হাম আসলে বায়ুবাহিত ভাইরাস জনিত রোগ। হাম রোগের ভাইরাস পরিবেশে প্রায় ২ ঘণ্টার মতো সক্রিয় থাকতে পারে। আবার, হাম রোগের ভাইরাস খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদিও টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে এটিকে অনেকাংশে রোধ করা হয়েছে, তবুও আফ্রিকার দেশগুলো কালো থাবা থেকে বের হতে পারে নি।
প্রকৃতপক্ষে এটি আসলে ছোঁয়াচে রোগ। খুবই দ্রুত বায়ু মাধ্যম যেমন হাঁচি, কাশি, কফ কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাস এর মাধ্যমে ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যদিও উন্নত দেশগুলো সাজানো- গোছানো চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারা
হাম রোগের ভাইরাসের নাম?
হাম রোগের ভাইরাসের সাধারণ নাম হাম ভাইরাস। তবে, এই ভাইরাস এর প্রকৃত নাম Measles morbillivirus (MeV)। এটি এক ধরণের আরএনএ ভাইরাস। এই ভাইরাসের প্রকৃত বাহক এখনও সনাক্ত করা যায় নি।
Realm: Riboviria
Kingdom: Orthornavirae
Phylum: Negarnaviricota
Class: Monjiviricetes
Order: Mononegavirales
Family: Paramyxoviridae
Genus: Morbillivirus
Species: Measles morbillivirus
হাম রোগের চিকিৎসা
যদিও হাম রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নাই, তবুও সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে রোগ সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। তবুও কিছু দিকনির্দেশনা অবশ্যই একজন রোগীকে মেনে চলতে হবে। যেমন,
জ্বরের নিয়ন্ত্রণ
জ্বর কমানোর পাশাপাশি শরীরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন প্রয়োগের পরামর্শ দিতে পারেন। শরীরে জলের পরিমাণ বাড়ানো (হাইড্রেশন) প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া প্রয়োজন। জ্বরের সময় শরীরে জলের অভাব না হয়ে ডিহাইড্রেশন-এর আশঙ্কা না হয়। কাশির জন্য গলায় ব্যথা হলে প্রভূত পরিমাণে গরম পানীয় নিলে আরাম বোধ হয়।
চোখের যত্ন
চোখ পরিষ্কার রাখতে হবে। আবার, চোখের পাতা বা চোখের ওপরে লোমের তলায় কিছু উঠতে দেখা গেলে তা জলে ভিজিয়ে পরিষ্কার তুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। কড়া আলোয় চোখ ব্যাথা করে তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী কম আলো এবং পর্দা ব্যবহার করতে পারেন।
কাশি এবং ঠান্ডা লাগা
যদি কখনো হামের সঙ্গে ঠান্ডা লাগা এবং কাশি হয়, চিকিৎসা করাতে নির্দিষ্ট ঔষুধ প্রয়োগ করবেন।
অন্যান্য পদক্ষেপ
উপসর্গের দিকে নজর রাখুন, যেমন শ্বাসকষ্ট, রক্তবমি, ঝিমঝিম করা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা এবং তড়কা উপসর্গের আভাস পেলে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করুন বা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান।
হাম হলে কি খেতে হবে
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর ও বল বৃদ্ধিকারক খাবার খাওয়াতে হবে। বিভিন্ন ধরণের ফুড চার্ট অনুসরণ করতে হবে। যে ধরণের খাবারগুলোতে এলার্জি আছে, সেই ধরণের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
আবার, অনেক জায়গায় কুসংস্কার আছে যে, হাম রোগীকে আমিস জাতীয় খাবার থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। আমিষজাতীয় খাবার একজন হাম রোগীর জন্য খুবই প্রয়োজন। শরীরে বল ফিরে পেতে আমিষের বিকল্প নেই।
তবে, পাকস্থলী কোনোভাবে আক্রান্ত হলে এই ধরণের খাবার বিপদের কারণ হতে পারে। তাই, ডাক্তার কিংবা বিশেষজ্ঞ সর্বদাই তরল জাতীয় খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন।
আরোও পড়ুনঃ জানতে হবে পোলিও রোগের জীবাণুর নাম কী
শিশুদের জন্য বিশেষ পরামর্শঃ
- মায়ের দুধ খাওয়া ছোট শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়াবেন। বড় বাচ্চাদের দিতে হবে ভাত, ডাল, ফলের রস, সবজি, স্যুপ, দুধ, মাছ, ডিম সবই।
- বয়স পাঁচ থেকে ছয় মাস পার করা এবং ভাত শুরু করা বাচ্চাকে ফেনা ভাত, হালকা গরম দুধ, ফলের রস, ডাল, চটকানো সবজি বা পাকা কলা, স্যুপ দিতে হবে নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট অনুসরণ করে।
- বাচ্চা অসুস্থতার কারণে একবারে বেশি খেতে না চাইলে বারবার রুটিনমাফিক অল্প অল্প করে খাওয়ান। একই খাবার বার বার না দিয়ে, খাবার বদল করে দিন। এতে করে রুচি বজায় থাকবে।
- যদি কোনো কারণে শিশু খেতে না চাইলেও কোনও অবস্থাতেই স্বাভাবিক খাবার বন্ধ করবেন না বা শুধু দুধ খাওয়াতে শুরু করবেন না।
- হামে আক্রান্ত যে কোনও বাচ্চাকেই জল ফুটিয়ে কিংবা ফিল্টার করে ঠান্ডা করে খাওয়ানো ভালো।
- হাম হলে মাছ মাংস ডিম খাওয়ানো বন্ধ করে দেওয়া শুধু কুসংস্কার, বাচ্চার পক্ষে ক্ষতিকর।
- খাওয়াতে পারেন টাটকা ছানার সন্দেশ, রসগোল্লা, পুডিং কাস্টার্ড জাতীয় মিষ্টান্ন।মন ভালো রাখার পাশাপাশি যত ভালো খেতে পারবে বাচ্চা দুর্বল হবে কম।
2 replies on “হাম রোগের লক্ষণ ও করনীয়”
[…] পড়তে পারেনঃ হাম রোগের লক্ষণ ও করনীয় এবং পোলিও রোগের জীবাণুর নাম […]
[…] আরোও পড়তে পারেনঃ হাম রোগের লক্ষণ ও করনীয় […]